দোহা ভ্রমন -4
দোহা তে ট্রানসিট ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট ঢোকার আগে। কাতারের রাজধানী। অনেক শুনেছি কাতার সমন্ধে। ভাগ্য ভালো এই ট্রানসিট ছিল ১২ ঘন্টার এবং কাতার এয়ারলাইন্স সদয় হয়ে রাজধানীর ভিতর হোটেল দিল। এরাবিয়ান হোটেল মনে হল পুরানো আমলের মাটি দিয়ে সুন্দর ছিমছাম Boutique হোটেল ছিল। আমরা হোটেলে ঢোকা মাত্র আমাদের ভ্রমন কো-ওরডিনেটর বাংলাদেশী, আসাদ ভাই, ম্যানেজার পদবীর সেলস ডিপার্টমেন্ট এ, তিনি বললেন, একটু সবাই খেয়ে (লাঞ্চ) আমরা সবাই শহর ভ্রমন দিব (করবো)। লাঞ্চ দেখি এলাহী বাফেট। চেয়ার টেবিলে যদিও সবাই খাবার নিয়ে নিয়ে খাচ্ছিল কিন্তু লোভ লাগছিলো ট্র্যাডিশনাল সিটিং এরেঞ্জমেন্ট দেখে। আমাদের পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী যেমন গদী ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনার জন্য যেটা আপনী নরসিংদী, মাধব্দীতে দেখবেন বিশাল গদী অনেকে বসার জন্য। তেমনি আপনী চাইলে গদী বৈঠকে বসে খেতে পারবেন। এটা যেহেতু কাতার তাই সমস্ত এরাবিয়ান ডিশ আপনার জন্য বাফেটে।
ড্রাইভার এসে হাজির। আমরা যারা এই হোটেলে উঠেছি তাদের জন্য কয়েকটা টয়োটা লেটেস্ট মডেল এর প্রিমিও কার। ড্রাইভারদের দেখি আমি অবাক। সবাই বাংলাদেশি। হোটেল থেকে যখন হেঁটে গাড়িতে উঠলাম শরীরটা যেন পুড়ে গেলো গরমে এবং সূর্যের তাপে। আমি সব সময় সামনের ছিটে বসতে পছন্দ করি। কাউকে কিছু না বলে চড়ে বসলাম সামনের সিটে। একজনের সাথে কথা বলে পরিচিত হলাম, যায়েদ ভাই এর সাথে উনি ফিনান্স এর হেড বিজিএমএ এর বাংলাদেশ শাখায়। খুবী অমায়িক ভদ্রলোক। হাসিখুশী এবং বড় মাপের। উনাকে নিয়ে পরবর্তীতে একটা ঘটনা ঘটেছিল সেটা পরে বলবো সুইজারল্যান্ডের বর্ণনায়। ড্রাইভার চমক দিল সবগুলো ভাড়া করা গাড়ির মালিক বাংলাদেশী। প্রাউড ফিল করলাম। ড্রাইভারকে বললাম, আমি ডলার দিব আমাকে কিছু কয়েন দিবেন সংগ্রহের জন্য। ড্রাইভার আমাকে অনেকগুলো কয়েন দিল যা বাংলাদেশী টাকায় ৩০০ টাকার মত হবে, কিন্তু কিছুতেই টাকা বা ডলার নিলেন না। উনি বললেন উনারও ভাল লাগছে বাংলাদেশীদের পেয়ে।
আমরা বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরলাম- সেন্ট্রাল মিউসিয়াম, মসজিদ, কতগুলো শপিংমল যা কিনা এরাবিয়ান সি এর পাশে। মলগুলো এতো সুন্দর, ওয়েল ডেকোরেটেড ছিলো যে ইউরোপ এর দেশগুলোতেও এত জৌলুশপনা লোক নাই।
ইউরোপ এর ষ্টোর গুলোইয় আপনি যে ড্রেস পরেই যান আপনার কিছু মনে হবে না কিন্তু মধ্যপ্রাচ্চ এর সবগুলোতে নিজেকে কিছুটা হীন মনে হলো।
মিউসিয়াম এর সামনে অবাক হলাম। কোথায় যেন দেখেছি কিন্তু জীবনে প্রথম যেহেতু কাতারে এসেছি তাই সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে কোথাও গেলে খুব পরিচিত মনে হয়। মনে হয় আগে এসেছি। প্রচুর বই, ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগে হয়তো কখনো কোন কল্পনায় বা সৃতিতে আস্তে পারে। তখন মনে হল ল অব এট্রাকশন এর কথা। আপনি যেটা বার বার দেখবেন, চিন্তা করবেন কোনভাবে যেটা সামনে পাবেন। ভিসুয়ালাইস থেকে মেটারিয়ালাইস হওয়ার সিক্রেট বেশির ভাগ লেখকরা লিখেছেন ল অব এট্রাকশন। মজার ব্যপার কাতার ঘুরে আসার ৬মাস পর বাসায় এবং ম্যাগাজিনে দেখলাম এই মিউসিয়াম এর ছবি এবং বর্ণনা। পরে মনে হল এই কারনে হয়তো চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু যারা যারা রিইনকানেকশন এ বিশ্বাস করেন তারা হয়তো বলবেন মনে হই আপনি পূর্ব জন্মে গিয়েছিলেন।
যাই হোক মিউসিয়াম এর ভিতর অনেকটা অন্ধকার, শুধুমাত্র অবজেক্ট গুলো আলকিত করা হয়েছে। সিকোয়েন্স গুলো ভালো ছিল মনে হচ্ছিল পারসিয়ান কোনো রাজার বাসভবনে ঢুকেছি। কোন এন্ট্রেন্স ফি ছিলোনা। রাজকীয় তরবারী, জামাকাপড় থেকে সব কিছু ছিল। এরাবিয়ান মেয়েরা ম্যানেজ করছে, গাইড করছে যদি কিছু জানার জন্য। সবাই হিজাব পরেছে, সম্পূর্ণ কালো হিজাব। হঠাৎ হঠাৎ দেখবেন কালো হিজাব পরে বসে বসে কাজ করছে। পাশেই একটা গ্লাস স্ট্রাকচার এর বিল্ডিং, এটা শুরু হচ্ছে-Opening Soon. এতো সুন্দর আর্কিটেড দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এক পাশে সমুদ্র, গরমের জন্য যেন সি-বিচ তেমন উপভোগ্য না। কিন্তু অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য । টায়ার্ড লাগছিল কারন রাতে জার্নি করে সকালে এয়ারপোর্ট তারপর দুপুর থেকে ঘোরা, সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরলাম। কিছু শপিং করলাম মাত্র। ড্রাইভার বাংলাদেশী, নাম রনি। অনেক কিছু জানলাম। নিয়ম খুব কড়া। কয়েকদিন আগে দুজন খুব ছোট খাট এক্সিডেন্ট করায় ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হলে দেশে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু রাস্তা যেহেতু ফাকা তাই সবাই খুব ড্রাইভিং করে মজা পায়। একজন বাংলাদেশী এক কাতারী মহিলাকে বিয়ে করে নাগরিকত্ব পেয়েছে, এরকম আরও অনেক গল্প। ভালো লাগছিলো। এই ভ্রমনের পর আমি আরো ১৬/১৭ টি দেশে ঘুরছি কিন্তু সব সময় কোন বাংলাদেশী পেলে তারকথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। তাদের কথা, দেশকে মনে পড়ার কথা এবং সব সময়ই তারা খুব হেল্পফুল ছিলো সুইজারল্যান্ড এ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনে ও। মনে আছে আমি এবং আমার ওয়াইফ মালয়েশিয়া ঘুরতে গেলাম, যেখানে বাংলাদেশি পেয়েছি শপ এবং রেসিডেন্ট এ। আমাদের অনেক ডিস্কাউন্ট দিল। বিনা মূল্যে ড্রিঙ্কস পরিবেশন করলো।
যাই হোক সারাদিন ঘুরে হোটেলে এসে গোসল করলাম। এখোনো প্রায় ৩ ঘন্টা বাকী। ফ্লাইট এর সবাই বললে কমপক্ষে ২ঘন্টা ঘুমানো যায়। মনে হচ্ছিলো জেট লেগ এ মাথা ধরে আছে।
আমাদের এই ট্রিপ বেশ কিছু বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি ছিলো-শ্রীলঙ্কান, পাকিস্থানি, ভারতীয়, তুর্কী, যারা কেউ কেউ ফ্যাক্টরি জি.এম. হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে পাকিস্থানি ফয়সাল ভাই, জাবের-যুবায়ের গ্রুপে জি.এম. হিসেবে ছিলেন। প্লেনে উঠে তার পাশের দুই সিটে কেউ না থাকায় হ্যান্ড রেস্ট খুলে ঘুম। সেকি ঘুম।
আমরা যারা এখানে বাংলাদেশের ভিতর ভ্রমন করতাম- রোমান, পারভেজ, মাইনুল, রকি, তানভীর, মুরাদ, মামুন। আমরা প্রতিটি ট্রিপ একটা গান সিলেক্ট করতাম – ট্যুর সং হিসেবে। এই ট্যুর সং কখনো পরে শুনলে সেই ট্যুর এর কথা মনে পড়তো। দেশের ভিতর অনেক ঘুরার কারনে ট্যুর এর উপকারিতাগুলো লাইফ এ অনেক সাহায্য করেছে।
গবেষণা ও ইউটিউব অনুসারে ট্যুর এর উপকারিতাগুলো-
১। এটা আপনাকে যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
২। আপনার ক্রিয়েটিভিটি বাড়ায়।
৩। আপনার মধ্যে লিডারশীপ গুন বৃদ্ধি করে।
৪। আপনার মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে।
৫। আপনার বিভিন্ন মানুষ, কৃষ্টি, কালচার সম্বন্ধে আপনার ধারনা সমৃদ্ধ হয়।
Comments
Post a Comment